১৯৬৬ সাল। পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য তখন চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজেদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করছিল। এই সময়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের এক মোড় ঘোরানো কর্মসূচি নিয়ে হাজির হন – ছয় দফা দাবি।
এই ছয় দফা ছিল একটি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন এবং সাংবিধানিক নিরাপত্তার দাবিতে সুসংগঠিত ও বাস্তবসম্মত রূপরেখা। অনেকেই একে বলেন – “বাঙালির মুক্তির সনদ”।
বঙ্গবন্ধু যে ছয় দফা উত্থাপন করেছিলেন তা মূলত ছিল:
১. ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা: শুধুমাত্র পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। বাকি সব কিছু প্রাদেশিক সরকারের হাতে।
২. আলাদা মুদ্রানীতি: পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব মুদ্রানীতি ও আলাদা ব্যাংক ব্যবস্থা চালু হবে।
৩. বাণিজ্য ও বৈদেশিক লেনদেন: প্রদেশ নিজেই রপ্তানি ও আমদানির নিয়ন্ত্রণ করবে।
৪. আলাদা রাজস্ব ব্যবস্থা: পূর্ব পাকিস্তান রাজস্ব আদায় ও ব্যবস্থাপনায় স্বাধীন থাকবে।
৫. আলাদা মিলিশিয়া ও প্যারা-মিলিটারি ফোর্স: পূর্ব পাকিস্তানে নিরাপত্তা রক্ষায় নিজস্ব বাহিনী থাকবে।
৬. অধিকারের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা: পূর্ব বাংলার অধিকার সংরক্ষণের জন্য সাংবিধানিক গ্যারান্টি থাকতে হবে।
এই ছয়টি দাবির প্রতিটিই ছিল এমনভাবে সাজানো, যাতে পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতরেই পূর্ব বাংলার পূর্ণস্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বাস্তবে এই ছয় দফা ছিল স্বাধীনতারই রূপরেখা।
বঙ্গবন্ধুর এই সাহসী ছয় দফা ঘোষণার পর পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী চরম ভীত হয়ে পড়ে। তাঁকে এবং তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হয়। শুরু হয় গণআন্দোলনের ঢেউ। হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নামে। জনতার একটাই দাবি – “ছয় দফা মানতেই হবে”।
বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ, মিছিল ও পুলিশের গুলিতে অনেক প্রাণ হারায়। কিন্তু তবুও কেউ পিছু হটেনি। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে ছাত্রসমাজ।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফা ভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে অংশ নেয় এবং ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টির বেশি জয়লাভ করে। পুরো পূর্ব পাকিস্তান একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে গ্রহণ করে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের রায় মানতে অস্বীকৃতি জানায়, ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্ব করতে থাকে। এর ফলেই ১৯৭১ সালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যদিও ছয় দফা মূলত স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে তৈরি হয়েছিল, পাকিস্তানের আচরণ এবং বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা একে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তর করে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন –
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এই ঘোষণা ছিল ছয় দফার রাজনৈতিক বিবর্তনের চূড়ান্ত রূপ — যেখানে একটি জাতি আর শুধু দাবি করছে না, বরং প্রস্তুত হয়ে গেছে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমরা ছয় দফাকে কেবল একটি রাজনৈতিক ইশতেহার হিসেবে নয়, বরং একটি জাতীয় চেতনার মাইলফলক হিসেবে স্মরণ করি।
আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিটি চেষ্টাই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দর্শনের মধ্যেই নিহিত।
দূরদর্শিতা: বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ না করেই, ধাপে ধাপে জাতিকে প্রস্তুত করেছেন স্বাধীনতার জন্য।
কৌশলগত নেতৃত্ব: তিনি পশ্চিমাদের ফাঁদে পা দেননি, বরং আইনের ভাষায় জনগণের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
জনসম্পৃক্ততা: ছয় দফা ছিল এমনভাবে প্রণীত যাতে একজন গ্রামের কৃষকও বুঝতে পারে কেন এই দাবি তার নিজের অস্তিত্বের সাথে জড়িত।
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল শুধু একটি রাজনৈতিক দাবিপত্র নয়, ছিল একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার রণকৌশল। এই ছয় দফাই বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তোলে, সংগঠিত করে এবং শেষমেশ ঐক্যবদ্ধ জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পথে নিয়ে যায়।
আজকের তরুণ প্রজন্মের উচিত ছয় দফার আদর্শ ও চেতনা ভালোভাবে জানা এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর বাংলাদেশকে গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করা।