গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিচার বিভাগ শুধু আইনের ব্যাখ্যা দেয় না—বরং সংবিধানের প্রহরী হিসেবেও কাজ করে। এর প্রধান দায়িত্ব হলো জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা, নির্বাহী ও আইনসভার ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ, এবং একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশে বিচার বিভাগ কি সত্যিই এই সংবিধানসম্মত দায়িত্ব পালন করছে?

দুঃখজনকভাবে উত্তরটা নেতিবাচক। আজকের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, আমাদের বিচার বিভাগ রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক প্রভাব এবং নিরাপত্তাহীনতার এক ঘূর্ণিবাত্যায় আটকা পড়ে আছে। জনগণের শেষ ভরসার জায়গা — আদালত — এখন অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এক প্রান্তিক যন্ত্রে রূপ নিচ্ছে।

সংবিধানের আলোতে বিচার বিভাগের দায়িত্ব

বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ বলছে, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে।” এটি কেবল একটি ধারা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের নৈতিক ও আইনগত রূপরেখার অপরিহার্য উপাদান। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যদি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে রাষ্ট্র আর জনগণের নয়—ক্ষমতার নিয়ন্ত্রকদের হাতে চলে যায়।

বিচার বিভাগ এমন একটি কাঠামো, যা রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গগুলো ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বশেষ আশ্রয় হতে পারে। কিন্তু আজ আমরা দেখছি, সেই আশ্রয়স্থলটি ধীরে ধীরে শক্তিহীন হয়ে পড়ছে।

সাহসী বিচারক কোথায়?

আমাদের ইতিহাসে এমন অনেক বিচারক ছিলেন যারা রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মাঝেও আইনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন—বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বিচারপতি হাবিবুর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বিচারকদের মধ্যে সেই দৃঢ়তা, সেই নৈতিক স্পষ্টতা আর আগের মতো দেখা যায় না।

বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রশ্নে আজকের বিচার বিভাগ যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এই নীরবতা কি শুধুই ভয়ের ফল? নাকি এর পেছনে রয়েছে একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক প্রভাব ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতি?

একজন বিচারক যখন সাহসী ভূমিকা নেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে পদচ্যুতি, বদলি বা তদন্তের হুমকি এসে দাঁড়ায়। বিচারকরা বাধ্য হন ন্যায়ের চেয়ে নিরাপদ অবস্থান বেছে নিতে।

রাষ্ট্রীয় বাধা: বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পথে সবচেয়ে বড় সংকট

বর্তমান বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, বিচার বিভাগের উপর সরকারের প্রভাব সরাসরি ও প্রভাবশালী:

  • বিচারকদের নিয়োগে রাজনৈতিক আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

  • বিচার বিভাগীয় প্রশাসন আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ।

  • স্পর্শকাতর মামলাগুলো নির্ধারিত “বিশেষ বেঞ্চ”-এ পাঠানো হয়।

  • আদালত ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক বৈধতা ও সংবাদ সেন্সরের হাতিয়ার হিসেবে।

এই প্রক্রিয়াগুলো বিচার বিভাগকে ধীরে ধীরে এক সরকার-নির্ভর কাঠামোতে পরিণত করছে, যেখানে বিচার নয়—ক্ষমতা টিকে থাকাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জনগণের আস্থা কোথায় যাবে?

বাংলাদেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ যখন নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে করে, তখন তার শেষ ভরসা হয় আদালত। কিন্তু যদি সেই আদালতই পক্ষপাতদুষ্ট হয়, মৌলিক অধিকার উপেক্ষা করে, বা ন্যায্যতার বদলে সুবিধাভোগীদের রক্ষা করে—তবে মানুষ যাবে কোথায়?

এই পরিস্থিতি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করছে না—এটি একটি জাতির আত্মবিশ্বাস, সামাজিক নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক চেতনাকে গভীরভাবে আঘাত করছে।

সমাধান কোথায়?

সরকার যদি সত্যিই সংবিধান ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হয়, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে:

  • সাহসী ও সৎ বিচারকদের নিরাপত্তা দিতে হবে।

  • বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও দলমুক্ত প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।

  • বিচার বিভাগকে প্রশাসনিকভাবে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত করতে হবে।

  • বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।

শেষ কথা

আজ আমরা বিচার বিভাগের সামনে এক মৌলিক প্রশ্ন রেখে যেতে চাই:
আপনি কি সত্যের পাশে দাঁড়াবেন, নাকি ক্ষমতার ছায়ায় নিজেকে আড়াল করে রাখবেন?
এই সিদ্ধান্ত শুধু বিচার বিভাগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না—নির্ধারণ করবে পুরো জাতির ন্যায়বিচারের ভবিষ্যত।