Politic

এপ্রিলে অর্থনীতির পতন: গতি হারাচ্ছে বাংলাদেশ?

এপ্রিলে অর্থনীতির পতন: গতি হারাচ্ছে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এক গভীর সংকেত দিচ্ছে। এপ্রিল মাসে পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স (PMI) রেকর্ড পরিমাণে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫২.৯ পয়েন্টে, যা সম্প্রসারণ পর্বের পর সর্বনিম্ন। এই পতন কোনো সাধারণ পরিসংখ্যান নয়—এটি দেশের অর্থনীতির গভীরে জমে থাকা অস্থিরতা ও অসংগতির প্রমাণ।

PMI মূলত অর্থনীতির স্বাস্থ্য, উৎপাদন, চাহিদা ও বাণিজ্যিক আস্থা পরিমাপের সূচক। এর এই নাটকীয় পতন সাময়িক ছুটি, বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতা বা মৌসুমি চক্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বরং এই পতনের পেছনে রয়েছে ব্যবস্থাগত অচলাবস্থা, নীতিনির্ধারণের স্বেচ্ছাচারিতা, এবং দীর্ঘমেয়াদে অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ফলাফল।

রাজনৈতিক বৈধতার সংকটে অর্থনৈতিক দুর্বলতা

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটি দ্বৈত সংকটে পতিত—একদিকে নীতিহীন নেতৃত্বের অস্পষ্ট দিকনির্দেশনা, অন্যদিকে জনগণের অংশগ্রহণহীন শাসনব্যবস্থা। অর্থনীতি একটি গাণিতিক বিষয় হলেও, তার ভিত রাজনীতি ও শাসন কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। যখন শাসকের নৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়, তখন তার গৃহীত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোও হয়ে ওঠে আত্মঘাতী।

বর্তমান পরিস্থিতিতে যাঁরা দেশের অর্থনীতির হাল ধরেছেন, তাঁরা নিজেদের আন্তর্জাতিক ইমেজ তৈরিতে যতটা সচেষ্ট, দেশের বাস্তব অর্থনীতির সংকট ততটাই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারণ এখন আর জাতীয় প্রয়োজনে নয়, বরং ব্যক্তি-আবেশ ও বাহ্যিক স্বীকৃতির মোহে চালিত। ফলে অর্থনীতি হয়ে উঠেছে এক ধরনের পরীক্ষাগারের ইঁদুর—যেখানে সাধারণ মানুষ ব্যর্থ নীতির বাস্তব পরিণতি ভোগ করছে।

শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যের পতনের ছাপ

PMI সূচকের পতন প্রমাণ করছে—উৎপাদন, নির্মাণ ও বাণিজ্য খাতে গতি কমছে। কৃষি খাতেও প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ। এ অবস্থায় যদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা চলতেই থাকে, তবে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, এমনকি রপ্তানি বাজারও হুমকির মুখে পড়বে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ এবং এমসিসিআই এর তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় PMI সূচক ছিল ৩৬.৯, যা ধীরে ধীরে কিছুটা উন্নত হলেও এপ্রিল থেকে আবারও নিচের দিকে যাচ্ছে। এটি নিছক ওঠানামা নয়—বরং একটি অদূর ভবিষ্যতের আর্থিক দুর্যোগের পূর্বাভাস।

দায় কার?

এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে এমন একটি প্রশাসনিক গোষ্ঠী, যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, অথচ রাষ্ট্র চালানোর সর্বোচ্চ দায়িত্বে রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দেশের বাস্তব চাহিদা ও কাঠামোগত দুর্বলতা উপেক্ষা করছেন। আন্তর্জাতিক পুরস্কার, সম্মাননা, কিংবা মিডিয়ার হেডলাইন – এগুলো হয়ে উঠেছে নীতিনির্ধারণের প্রেরণা। অথচ বাস্তবতা বলছে, এসব বাহ্যিক অর্জনের আড়ালে দেশের অর্থনৈতিক ভিত ভেঙে পড়ছে।

অন্ধকার ভবিষ্যতের বার্তা

রপ্তানিনির্ভর শিল্পে শুল্ক বৃদ্ধি, জ্বালানি ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক জট এবং আইনশৃঙ্খলার অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে অর্থনীতির প্রতিটি স্তর আজ অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এই অন্ধকারের দায় তাঁদের যাঁরা সংবিধান ও গণতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রের চালকের আসনে বসে আছেন।

এপ্রিলের এই PMI পতন কেবল পরিসংখ্যানগত সংকেত নয়, এটি একটি অ্যালার্ম বেল—যা কানে না তুললে সামনে অপেক্ষা করছে আরও গভীর আর্থিক সংকোচন, স্থবিরতা ও সামাজিক অস্থিরতা।

করণীয় কী?

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন—

  • সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা,

  • জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা,

  • বাস্তবভিত্তিক, গণমুখী নীতিনির্ধারণ এবং

  • নেতৃত্বে এমন ব্যক্তিত্ব, যিনি জাতীয় স্বার্থকে ব্যক্তিগত প্রচারের ঊর্ধ্বে রাখবেন।

না হলে আজকের অর্থনৈতিক ধস পরিণত হবে আগামীকালের সামাজিক বিপর্যয়ে।

উপসংহার

বাংলাদেশ আজ একটি দ্বিধাবিভক্ত পথের সামনে দাঁড়িয়ে। একদিকে রাজনৈতিক অপদর্শন ও জবাবদিহিহীন নেতৃত্ব, আরেকদিকে অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও জনগণের স্বার্থ। যতদিন এই রাষ্ট্র ‘উন্নয়নের ব্র্যান্ডিং’ এর আড়ালে সত্য আড়াল করতে থাকবে, ততদিন দেশের অর্থনীতি গতি নয়, গহ্বরের দিকে এগোতেই থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *